প্রভাতের সূর্যের আলোক এসে পড়ছে চোখে, কলতলায় অল্প করে চুঁইয়ে পড়া জল মুখে ছিটিয়ে শুরু হল তার আর একটি দিন। সে স্নান করে, সাদা পোশাক আর গান্ধী টুপি মাথায় পরল। নিজের ব্লকে বসে চারপাশের শূন্য দেওয়ালের দিকে তাকাতে তাকাতে অতীতের কথা মনে করা ছাড়া গত্যন্তর নেই, কিন্তু সূর্যের আলো এই অন্ধকার কুঠুরীতে এসে তাকে ভবিষ্যতের আশা দেয়। নিজের ব্লকে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী সে আমাদেরই মত। অথচ ওই চার দেওয়ালের বাইরে, তার হাতে হাত কড়া, পুলিস তাকে ঘিরে রয়েছে আর সমাজের শত সহস্র চোখ যেন গিলে খাচ্ছে।
একজন জেল বন্দীর জীবন দৈনন্দিন কাজকর্মের নিরিখে অন্যদের মতই স্বাভাবিক কিন্তু মনের মধ্যে চলে উথালপাথাল ঝড়- সে ঝড় হয় প্রতিশোধের, নয় অনুশোচনার, না হয় দুঃখের।
এক বছর আগেও বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল জেলে এটাই ছিল বাস্তব সত্য। কিন্তু, গত এক বছরে এই অবস্থার, কারারুদ্ধ মানুষদের এবং তাদের আচার ব্যবহারে একটি পরিবর্তন হয়েছে, - এই পরিবর্তন চিরস্থায়ী৷
জীবন কেড়ে নেওয়ার মত জঘন্য অপরাধের জন্য এরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, কিন্তু কথিত আছে পরিবর্তনই একমাত্র চিরস্থায়ী, তাই এদেরও রূপান্তর ঘটেছে।
এখন, এরাই বাঁচতে শেখায়...
সব কিছুর শুরু বছর খানেক আগে, যখন বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল জেলের ৩০ জন কয়েদীর জন্য দি আর্ট অফ লিভিংয়ের ইয়ুথ লীডার শিপ ট্রেনিং প্রোগ্রাম শুরু হয়েছিল। এই ওয়াই এল টি পি প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তি বিশেষকে আত্ম-নির্ভরশীল করে তোলা, তাকে নেতার যোগ্য করে তোলা যাতে সমাজের উন্নতির জন্য সে তৎপর হতে পারে।
“আমরা ওদের জন্য ৯০ দিনের ওয়াই.এল.টি.পি করিয়েছি যা সাধারণ কাঠামোর বাইরে। এখানে প্রতিদিন অনেক বেশী যোগ ও ধ্যানের অধিবেশন রাখা হত এবং সেই সব প্রক্রিয়া রাখা হত যার মাধ্যমে তারা নিজেদের অতীতের সঙ্গে, আবেগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে এবং নিজেদের মন কে সংযত করে সামলাতে শেখে। সান্ধ্য অধিবেশনে থাকত গান গাওয়া এবং তাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখা জ্ঞানের আলোচনা। এই প্রোগ্রাম বিশেষ করে সুদর্শন ক্রিয়ার শ্বাস পদ্ধতি ওদের জন্যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। এর মাধ্যমেই এই রূপান্তর সম্ভব হল” – জানালেন কর্ণাটকের জেল প্রোগ্রামের প্রকল্প অধিকর্তা শ্রী নাগরাজ গানগোল্লী৷
যে সব জেলবন্দীরা এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে তারা সকলেই ১-১২ বছর ধরে কারারুদ্ধ। অংশগ্রহণকারীদের প্রথমদলটি পুলিস বেছে দেয়। প্রথম দলের রূপান্তর দেখে দ্বিতীয় দলের অংশগ্রহণকারীরা নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসে।
এরপর তাদের দুটো অ্যাডভান্স্ড (পার্ট ২) প্রোগ্রাম করানো হয় যার মাধ্যমে তাদের পুরনো গভীর ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়ে, নিজেদের সম্বন্ধে ধারণা, ব্যবহার ও মনোভাব বদলায় এবং ভীতি দূর হয়। এ ছাড়া তারা নিজেদের মধ্যে স্থিতি ও শক্তি অনুভব করে যার ফলে তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যত সম্বন্ধেও আস্থাবান হয়।
“আগে এরা তাস খেলে সময় কাটাত, এমন কি ছাড়া পেলে একই অপরাধ আরও বড় আকারে কিভাবে করা যায় তার মতলব ভাঁজত; কিন্তু এখন তারা সম্পূর্ণই বদ্লে গেছে।” – বলেন নাগরাজ।
এখন এরাই পথপ্রদর্শক!
এর মধ্যে আর্ট অফ লিভিংয়ের শিক্ষক কমিটি এবং পুলিস উপলব্ধি করেন যে যদি এই জেল-বন্দীরা শিক্ষক হয়ে তাদের দলকে সঠিক শিক্ষা দেয় তাহলে আরও বিরাট পরিবর্তন আনা অবশ্যই সম্ভব। এবং এই ভাবেই ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর অপরাধী বলে চিহিৃত বন্দীরা যোগ ও ধ্যানের শিক্ষক হয়ে উঠল। দলের বাকি সদস্যরা এই অনন্য কয়েদী শিক্ষকদের নিয়ে গর্ববোধ করে এদের যুবাচার্য বলে ডাকত।
“আমাকে জেলের ৪০০০ আসামীর খাবারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।অন্য আসামীদের প্রশিক্ষণ দিতে আমার ভাল লাগে এবং তৃপ্তি ও আনন্দে মন ভরে ওঠে যখন তাদের মধ্যে রূপান্তর দেখি,”- জানালেন কয়েদী-শিক্ষক মোহন কুমার; তিনি আরও বললেন,-“প্রোগ্রামের পরে ১২ বছর ধরে জমে ওঠা চাপ থেকে যেন মুক্তি পেলাম। যোগ এবং ধ্যান আমার মধ্যে প্রবল ইচ্ছা শক্তি জাগিয়ে তুলেছে। জীবন সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে এবং আমার মন আরও স্থিত ও লক্ষ্যে স্থির হয়েছে।”
‘জেলের মধ্যে এতগুলো বছর প্রায় কিছুই না করে কাটানোর জন্য ভবিষ্যতের সুস্থ জীবনের আশা লুপ্ত হয়েছিল; ওদের এই রূপান্তর খুবই প্রয়োজন ছিল’ –সংশোধনাগারের অধিকর্তারা একথা জানালেন।
রাজ্য পুলিসের ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল আইপিএস অফিসার এস. রবি বলেন,- “সামগ্রিক ভাবে ভালো থাকার জন্যেও এই রূপান্তর প্রয়োজন। আগে এরা ছিল স্বভাবে অপরাধী, কিন্তু এই প্রোগ্রাম করে রূপান্তরের পরে এরা এখন অনেক উপযোগী হয়ে উঠেছে এবং এদের ব্যক্তিত্বেও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন খুব সহজে কোনো সামাজিক বাধা ছাড়াই এদের পুনর্বাসন করা যাবে। এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদের যুবাচার্য করার ফলে ‘চেন রিএ্যাকশনে’ এরা আবার অন্য আসামীদেরও শিক্ষা দিয়ে রূপান্তরিত করছে।”
আজ এই ৩০ জন জঘন্য অপরাধের আসামীরা প্রত্যেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে কারণ কর্ণাটকের বিদার, বেলারী, গুলবর্গা, বিজাপুর, ধারওয়ার, মাইশোর প্রভৃতি ৭টি সংশোধনাগারে ২৫০০ আসামীর জীবনে রূপান্তর আনতে এরা সক্ষম হয়েছে।
অবশেষে, তাদের দেখা হল…
বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল জেলেই এই ৩০ জন চরম অপরাধীর অপরাধী থেকে দক্ষ শিক্ষক হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু। জেলের বিশাল বিশাল চার দেওয়ালের মধ্যেই শিক্ষকরূপে দক্ষতা লাভ। আসামীরা নিজেদের এই রূপান্তরে বিস্মিত হয়ে জেল অধিকর্তাদের কাছে আবেদন জানায় যে যার জন্য এই রূপান্তর, যাঁর অনুপ্রেরণায় তাদের জীবনে এই পরিবর্তন, তাঁকে তারা একবার দেখতে চায়। এক বছর অপেক্ষার পরে, দি আর্ট অফ লিভিংয়ের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে একটি বিশেষ সাক্ষাতকারের জন্য তাদের জেলের বাইরে পা রাখার অনুমতি দেওয়া হল। রোজকার কয়েদীর পোষাক ছেড়ে ধোপদুরস্ত কুর্তা পাজামা পরে গাঢ় নীল রঙের ভ্যানে চড়ে এসে এই ৩০ জন দেখা করল শ্রী শ্রী রবিশংকরের সঙ্গে। এই দলটি তাঁর জন্য অপেক্ষা করার সময় প্রাণায়াম ও ধ্যান অভ্যাস করছিল। চারদিকে পুলিস, যারা গর্বিত হলেও সতর্ক,- তাদের মাঝে এই দলটি বসেছিল হাতে হাতকড়া ছাড়া – যেন তারা মুক্ত প্রাণ, অনুশোচনার অতীত থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে জীবন কাটাতে বদ্ধপরিকর।
তাদের এই রূপান্তর ও প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে দেশ গড়ার কাজে কোমর বেঁধে নেমে পড়তে শ্রী শ্রী তাদের অনুপ্রাণিত করেন। “আমরা একসঙ্গে কাজ করব যাতে মানুষের মধ্যে বিশ্বাস ফিরে আসে এবং মানবিক গুণগুলি প্রকাশ পায়।” সারা রাজ্য জুড়ে সংশোধানাগারে এই রূপান্তরের প্রকল্প যাতে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য এই দলটি শ্রীশ্রীর উপদেশ প্রার্থনা করে।
৩২ বছরের মহেশের কথায়,-“এখন জেলের মধ্যে আমি যাকে সামনে পাই তাকেই ধরে নিয়ে আসি যোগের ক্লাসে। আমি আমার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছি আন্তরিকভাবে যাতে আমি আমার পরিবারকে দেখতে পাই এবং দেশের একজন ভাল নাগরিক হয়ে উঠতে পারি।”
জেলে বন্দী হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ থেকেও সত্যিই তাদের মন পেয়েছে এক অনন্য মুক্তির স্বাদ!
লেখিকা – মনিকা প্যাটেল
আর্ট অফ লিভিং প্রকল্পে দান করতে ইচ্ছুক হলে ইমেল করুন:webteam.india@artofliving.org.