গুরুজীকে যেমন দেখেছি; - কিশোর দা

গুরুজীকে যেমন দেখেছি; - কিশোর দা
সকলের কাছে অতিপ্রিয় কিশোরদা। পেশাগতভাবে বৃটিশ মার্চেন্ট নেভিতে মেরিন ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে চোদ্দ বছরের কর্মজীবনে সারা বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছেন।

আমার জীবনে আধ্যাত্মিকতার প্রতি যে আকর্ষণ উৎপন্ন হয়েছিলো, তার জন্য আমি আমার পিতার কাছে সর্বতো ভাবে ঋণী। আমার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন থেকেই আমাদের বাড়ীতে সকলের সঙ্গে নিয়মিত ধ্যানাভ্যাস করতাম এবং তখন থেকেই আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যে সমাজের কাছ থেকে কেবল দাবী করার পরিবর্তে আমাদের উচিত সমাজকে কিছু দেওয়া।

চোদ্দ বছর বয়সে আমি পন্ডিচেরী গেছিলাম। সেখানে অরবিন্দ আশ্রমের আধ্যাত্মিক দর্শন এবং মাদারের শিক্ষা আমাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে, জীবনের এক নতুন অর্থ আমি উপলব্ধি করতে পারি।

১৯৮৫ সালে একটা ‘বেসিক কোর্সে’ আমি প্রথম গুরুজীর দর্শন লাভ করি। একটা ছোট্ট প্রচার লিপিতে লেখা ছিল, -‘এস এবং তোমার নিজের সঙ্গে পরিচিত হও’ (‘Come and meet yourself’ – and discover a new you)- এই আহ্বান আমাকে আকৃষ্ট করে। আপন স্বরূপকে উপলব্ধি করা! এক অসাধারণ অনুভূতি! আমি ভেবেছিলাম যে প্রসিদ্ধ সেতার বাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর এই ক্লাস নেবেন, এবং সেই কারণে সেখানে যেতে আগ্রহী হয়েছিলাম। (তখন গুরুজী পণ্ডিত রবিশঙ্কর নামেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে প্রায় এই শতাব্দীর শুরুতে তিনি শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর নাম গ্রহণ করেন।) গুরুজী স্বয়ং সেখানে ক্লাস নিচ্ছিলেন, যা বর্তমানে সকলের কাছে ‘বেসিক কোর্স’ বলে সুবিদিত, এবং তোমরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ যে তা কেমন ভাবে সকলকে বিমুগ্ধ করে রেখেছিলো। প্রথমেই গুরুজী আমাদের মিনিট চল্লিশের একটা ধ্যান করান; তার প্রভাব এত গভীর ছিল যে আমার মনে হল সময় যেন থমকে গেছে! চোখ খুলে গুরুজীকে দর্শন করে আমি উপলব্ধি করতে পারি যে আমাদের সম্পর্ক বহু জন্মের এবং গুরু/শিষ্য পরম্পরার প্রকৃত সত্য আমার কাছে উন্মোচিত হয়ে গেলো।

আমি তখন মেরিন ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে সারা পৃথিবী ঘুড়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু গুরুজী আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। তিনি আমাদের কলকাতার বাড়ীতে ফোন করে অথবা পোষ্টকার্ডে দু’লাইন চিঠি লিখে আমাকে লন্ডন, ফ্রান্স, অথবা হৃষিকেশে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আহ্বান জানাতেন। আমি গুরুজীর জন্য ‘বেসিক কোর্স’ সংগঠিত করতে শুরু করি এবং ধীরে ধীরে গোটা বিষয়টা সম্যক না জেনেই ‘আর্ট অফ লিভিং’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। ১৯৮৭ সালে গুরুজী আমাদের কলকাতায় আসতে নির্দেশ দেন এবং সেখানেই সর্বপ্রথম ‘টিচারস ট্রেনিং কোর্স’ (টি টি সি) অনুষ্ঠিত হয়। সেই কোর্সে আমি, শশী এবং গুরুজীর আরও চারজন অনুগামী উপস্থিত ছিলাম। গুরুজী স্বয়ং সেই কোর্স নেন এবং আমরা তাঁর নির্দেশমত সমস্ত প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধ করি। এইভাবেই সর্ব প্রথম ‘টিচারদের ম্যানুয়াল’–এর সৃষ্টি হয়েছিল! আমরা তখন ‘বেসিক কোর্স’ নেবার যোগ্যতা অর্জন করি এবং আমার প্রথম ক্লাসে দু’জন অংশ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বর্তমানে যেখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ১৯৮৬ সালে গুরুজীর সঙ্গে আমি প্রথম সেই স্থান দেখতে যাই। সেখানে কেবল পাথর আর বিক্ষিপ্ত কিছু ঝোপঝাড় ছিল, আর সেই জায়গা ঘেরা না থাকার ফলে কিছু অবৈধ দখলদার জমি দখল করে রেখেছিল। কেউ কল্পনাও করতে পারতনা যে সেই রুক্ষ, ঊষর স্থান বর্তমানের এমন সবুজে ভরা মনোরম রূপ গ্রহণ করতে পারে। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারী মাসে পিতাজী (গুরুজীর পিতা) সেখানে বিদ্যালয় গড়ার উদ্দেশ্যে একটা ছোট্ট ঘর নির্মাণ করেন। সেখানে কোন জলের ব্যবস্থা না থাকায়, তখন আমাদের নিকটবর্তী গ্রাম থেকে জল বয়ে নিয়ে আসতে হত। পিতাজী সেই কারণে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করেছিলেন। একটা কুয়া খনন করা হয়েছিল, এবং বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার পর পুরোদমে কাজ শুরু হল। কিছু অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল, কিন্তু সেই অবস্থা আমাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কাজকর্ম এবং দ্বিতীয় ‘টিচার্স ট্রেনিং কোর্স’ সংগঠিত করার থেকে বিরত করতে পারেনি। ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় ‘টিচার্স ট্রেনিং কোর্স’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই কোর্সে তিরিশ জন অংশ নিয়েছিল এবং তারা প্রত্যেকেই টিচার হয়েছিল। ১৯৯১ সাল থেকে প্রকৃত নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গুরুজী ‘বেদ-বয়েজদের’ সঙ্গে সেখানে বাস করতে শুরু করেন।

আমিও ১৯৯১ সালে স্থায়ীভাবে আশ্রমে বসবাস করতে শুরু করি, এবং তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমরা তখন প্রায় তিরিশ জন সেখানে বাস করতাম। সে সময়টা ছিল উদ্দীপনা, আনন্দে পূর্ণ এবং একই সঙ্গে দায়িত্বভার বহনের, কারণ তখন আমাদের প্রচুর কায়িক পরিশ্রম করতে হত, - বৃক্ষ রোপণ করার জন্য গর্ত করা থেকে শুরু করে পাইপ পাতার জন্য মাটি খোঁড়া পর্যন্ত সবকিছু। তখন বেশি গাড়ি না থাকার জন্য আমাদের বাসে করে শহর থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু, এমনকি চাল-ডাল, সব্জী ইত্যাদি কিনে আনতে হত এবং আমরা নিজেরাই রান্না করতাম। অনেকে আমাকে প্রশ্ন করে যে গুরুজী সবথেকে উল্লেখযোগ্য অলৌকিক কি ঘটনা ঘটিয়েছেন? আমি তাদের বলি প্রথম হল এই আশ্রম। শূন্য থেকে শুরু করে এই বিশাল বিস্তৃত আশ্রম প্রতিষ্ঠা, তাও অতি সামান্য সঙ্গতি নিয়ে! বিভিন্ন মানুষ নির্দিষ্ট কাজের সময়ে এসে ঠিক সেই কাজটুকু করে চলে গেছেন। কেউ গাছের চারা রোপণ করেছেন, কেউ ইমারত তৈরীর নকশার কাজে সহায়তা করেছেন, পাহাড়ের ঢালে অকল্পিতভাবে বাড়ী তৈরী হয়েছে, রাস্তা নির্মাণ হয়েছে, অফুরন্ত জলের উৎস পাওয়া গেছে, এই সবই অলৌকিক ঘটনা ছাড়া আর কি।
দ্বিতীয় হল,- যেটাকে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সবথেকে বিস্ময়কর বিষয়ের থেকেও বিস্ময়কর বলা যেতে পারে, তা হল মনের পরিবর্তন। অসংখ্য মানুষ যাঁরা এই কোর্স করেছেন, তাঁদের মধ্যে অপরের প্রতি একাত্মবোধ জেগে উঠেছে। বিশ্ব জুড়ে এঁদের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। ছোটখাটো বিষয়েও এই অলৌকিক শক্তির প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। কারও মনে কিছু ইচ্ছা জেগে উঠল আর সেটা পূরণ হয়ে গেল! গুরুজী তোমাদের উপরে কিছু দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছেন, এবং তা সম্পাদন করার জন্য ক্ষমতা ও যোগ্যতা দুটোই প্রদান করেছেন। সারা বিশ্বজুড়ে এর প্রসার বিস্ময়কর। বর্তমানে ন্যূনাধিক একশো-পঞ্চান্নটি দেশের মানুষ গুরুজীর প্রেমের বন্ধনে একত্রিত হয়ে গেছে। একবার ফ্রাঁসোয়া (গুরু অফ জয়ে’র রচয়িতা) আমার কাছে জানতে চায় যে গুরুজীর সব থেকে বড় বিস্ময়কর ঘটনা বলতে আমি কোনটাকে বলব। আমি তাকে বলি যে “গুরুজীর অহৈতুকী প্রেমই সবথেকে বিস্ময়কর বিষয়! কি করে তাঁর সান্নিধ্যে কান্না নিমেষে হাসিতে পরিণত হয়, কি করে বিরূপ মনোভাবাপন্ন মানুষ দয়ার্দ্র হয়ে পড়ে”! আমার মনে আছে একবার আমি গুরুজীর সঙ্গে প্লেনে যাত্রা করছি। আমি আজও অবাক হয়ে ভাবি একজন অতি উগ্র মহিলা কেবল গুরুজীর দৃষ্টিপাতেই কেমন করে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে গেলেন! আমার অনেক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করে যে আমার বিগত পেশাগত জীবনের কাজের সঙ্গে বর্তমানে ‘আর্ট অফ লিভিং’এর পূর্ণ সময়ের সেবক হিসাবে কাজের ধারার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব উৎপন্ন হয় কি না? আমি তাদের বলি যে গুরুজী আমার পূর্বেকার কার্য ক্ষমতাকে বর্তমানে শতগুণ বাড়িয়ে তুলেছেন। ‘আর্ট অফ লিভিং’এর মাধ্যমে তিনি আমার জীবনকে পূর্ণতা প্রদান করেছেন। তিনি আমার পূর্বেকার বিশ্বাসকে খণ্ডন না করে  বরঞ্চ তাকে আরও সুদৃঢ় করেছেন। খুব সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় যে গুরুদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। নশ্বর জগতে এই দ্বন্দ্বের অবকাশ থাকে; প্রত্যেক গুরুই ঈশ্বরের অংশ এবং তাঁরা তাঁদের প্রদত্ত আপন আপন কর্মভার পালন করে যান। কোন সন্দেহ নেই যে তাঁদের মধ্যে যে যোগাযোগ তা চেতনার উচ্চ স্তরের পর্যায়ভুক্ত। আমাদের মত তাঁদের সশরীরে পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়োজন হয় না। গুরুদের কাছে সকলেই কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন প্রত্যাশা করে। কিন্তু সেটা ছোট মনের বিষয়। বড় মন অনুভব করে যে দিব্যতা সর্বদা বিদ্যমান এবং তাঁর কৃপা সর্বদাই আমাদের সঙ্গে রয়েছে। এটাই হল সর্বাপেক্ষা বড় বিস্ময়কর ঘটনা, জীবনের সবথেকে বড় বিস্ময়কর উপলব্ধি।

‘আর্ট অফ লিভিং’এর শুরু ও বিকাশ; - কিশোরদার স্মৃতিচারণ থেকে

ঋষি অরবিন্দ বলেছেন, “যে দিব্যতার আশ্রয় খোঁজে, জানবে দিব্যতা তাকে অনেক আগে থেকেই নির্বাচিত করে রেখেছে।” আমার কাছে শ্রী শ্রী সবকিছু,- মাতা, পিতা, ভাই, মিত্র। তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ এমন একটা পর্যায়ের, ঠিক যেমন মাতা-পিতা তাঁদের শিশুদের পালন করে থাকেন। সেই সময় ভারতবর্ষে কেউ ছিলনা যে শ্রী শ্রী’র বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি কিছু অনুগামীকে নির্বাচিত করে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদেরই প্রচেষ্টায় শ্রী শ্রী’র জ্ঞান ‘আর্ট অফ লিভিং’ এর মাধ্যমে চারিদিকে বিস্তৃত হতে থাকে।
প্রথম টিটিসি’র প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিশোরদা বলছেন, - “সেই প্রশিক্ষণ ছিল দশ দিনের। এত সহজ সরল উপায়ে তিনি সেই জ্ঞান প্রদান করলেন, তা অভূতপূর্বও! আমরা কোন সময় বুঝতেই পারিনি যে আমাদের কিছু শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর স্নেহময় প্রজ্ঞার পরশে আমরাও সহজে আত্মজ্ঞানকে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছিলাম। প্রতিটি দিনই নতুন নতুন বিস্ময় আর বিমুগ্ধতায় ভরে যেত। আগে কি হতে চলেছে সে বিষয়ে কোন ধারণাই আমরা করতে পারতাম না। সহজ এবং সাবলীল অথচ নতুন ঢঙে সমস্ত উদাহরণ দিতেন। সরস, কৌতুকপূর্ণ পরিবেশে গূঢ় জ্ঞানের উপদেশ দিতেন। প্রশিক্ষণ শেষ হবার পূর্বেই আমার মধ্যে এক গভীর পরিবর্তন ঘটে গেল। ওই দশদিন জীবনের এক অবিস্মরণীয় পর্ব হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেলো। শ্রী শ্রী বললেন যে মনের উপর নিয়ন্ত্রণই সবথেকে মহত্ত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলতেন, ‘যেকোন মূল্যে মনকে রক্ষা কর।’ এই জ্ঞান সমস্ত উপনিষদ, গীতা এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মূল কথা।”
গুরুজী আমাকে ভারতের সমস্ত স্থানে প্রেরণ করলেন। সেসব জায়গায় তখন কোন সেন্টার ছিলনা, সাহায্য করার কেউ ছিলনা, এমনকি পরিচিত কোন ব্যক্তিরও সন্ধান জানতাম না। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে করতে আমার আত্মবিশ্বাস আরও সুদৃঢ় হয়ে উঠল। কোন হিসাব না করেই যে কোন স্থানে চলে যেতাম। সর্ব প্রথম জেলের কয়েদীদের জন্য নৈনী জেলে গুরুজী স্বয়ং ক্লাস নিয়েছিলেন। পরে আমাকে তিনি চন্ডীগড়ে জেলের কয়েদীদের ক্লাস নেবার জন্য নির্দেশ দেন। আমি তাঁর নির্দেশ মত সেখানে গেলাম। কিন্তু অধ্যক্ষ অনুমতি দিলেন না। কারণ তখন সেখানে কিছু খলিস্থানী সন্ত্রাসবাদী বন্দী ছিল। আমি অধ্যক্ষকে বললাম, “আমাকে তো কোর্স করাতে হবে।” আমি সরাসরি ভিতরে কয়েদীদের কাছে চলে গেলাম। জেল অধ্যক্ষ হতচকিত এবং ম্রিয়মাণ হয়ে গেলেন। শ্রী শ্রী’র নির্দেশে দিব্য শক্তি কাজ করতো, - “যাও, কর” – শুধু এই আদেশটুকুই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। তিনি যা বলেন তা সত্য হয়। নিজের বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। এর ফলে আপন শক্তির হ্রাস হয়। সর্বত্র তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
প্রথম বার গুরুজী আমাকে মহারাষ্ট্রের নাগপুরে যাবার নির্দেশ দিলেন। সেখানে আমার পরিচিত কেউ ছিলনা। আমি নাগপুরে পৌঁছে গেলাম। একটা মন্দিরে গেলাম। সেখানে ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক আসতেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হবার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স নিলাম। এইভাবে নাগপুর থেকে গুজরাটের একটা যোগসূত্র পাওয়া গেল। আহমেদাবাদে বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি কোর্স নিলাম। আমি কখনও বিধিবদ্ধ ভাবে কোর্সের বিষয়ে কাউকে বলতাম না। নিজের অনুভবের কথা বলতাম। আমার কথা মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করত।
এইভাবে খুব সহজেই মানুষ কোর্স করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত। সেই সময় আমাদের কাছে কোন প্রচার পুস্তিকা, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি কিছুই থাকত না। সামান্য হাতেগোনা কিছু লোক, সংসাধনও যৎসামান্য। কিন্তু গুরুজী বলতেন – “জীবনে কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হয়েই শক্তিশালী হতে পারবে, তাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়।” তিনি সর্বদা এই শিক্ষাই দিয়েছেন যে আমাদের অপরের জন্য বাঁচতে হবে, আমরা পৃথিবীতে জন্মেছি অন্যদের কিছু দিয়ে যাবার জন্য। এই কারণে আমাদের অন্তরের ডাক শোনা উচিৎ, বিচারের জালে জড়িয়ে পড়া উচিৎ হবেনা। তাঁর জীবন এই শিক্ষার যথার্থ উদাহরণ। তিনি কোনদিন আমার উপর কোন দায়িত্ব জোর করে চাপিয়ে দেননি। তাঁর জীবন যাপন আমাকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তাঁর কাছে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পিত করে দিয়েছে।
তিনি সদ্‌গুরু। কোনকিছুর প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আসক্তি নেই। আশ্রম নির্মাণের কোন ইচ্ছাই তাঁর ছিলনা। লোকজন আসতে লাগল, কাজ বাড়তে লাগল, আর এইভাবেই আশ্রম গড়ে উঠল। একজন জাদুকরের ঝোলা থেকে যেমন বিস্ময়কর জিনিস বেড়োতে থাকে, তেমনি বিস্ময়করভাবে ধীরে ধীরে সবকিছু গড়ে উঠতে লাগল। তাঁকে দর্শন করে বিস্ময় ছাড়া কিছুই জাগেনা। তখন তিনি কোন প্রকল্পের অতি নগণ্য দিকগুলোকেও বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন যে কোন্ কাজ কিভাবে সম্পন্ন করতে হবে। তাঁর দূরদৃষ্টি অবর্ণনীয়। তাঁর বিশাল দৃষ্টিভঙ্গী এবং দূরদর্শিতার ফলে একটা ক্ষুদ্র অঙ্কুর আজ বিশ্বব্যাপী মহীরুহে পরিণত হয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের ঢল এক জনসমুদ্রের রূপ ধারণ করেছে।