সমাজের কল্যাণের জন্য জন্ম জন্মান্তর ধরে একের পর এক গুরু জ্ঞানের ধারাকে বয়ে নিয়ে চলেন আর প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সেই জ্ঞান প্রদান করেন। একেই বলা হয় গুরু পরম্পরা। এটাই হল গুরুর থেকে শিষ্যের কাছে জ্ঞানের প্রবাহের ঐতিহ্য। ভারত উপমহাদেশের প্রধান প্রধান জ্ঞানপীঠ এই ধারাকে সংরক্ষিত করে রেখেছে।
গুরু পরম্পরার গুরুত্ব
গুরু শিষ্য পরম্পরার এই প্রথা নিশ্চিত করেছে যাতে প্রতিটি প্রজন্ম এই জ্ঞানের শক্তি উপলব্ধি করে তাদের চিরপরিচিত কষ্ট – মানসিক যন্ত্রণা থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারে।
গুরু পরম্পরার সকল গুরু এই চিরন্তন জ্ঞানকে সেই সময়ের উপযোগী করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এই বিশ্বে গুরুপরম্পরার অবদান অপরিসীম । তাঁদের দ্বারা মহৎ সব শাস্ত্র রচিত হয়েছে, এবং প্রত্যেক গুরুর বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব আমাদের হৃদয়ে রয়ে গেছে। কিছু সময়ও যদি আমরা তাঁদের স্মরণ করি তাহলে তাঁদের গুণ আমাদের মধ্যে বিকশিত হয়ে উঠবে।
অদ্বৈত গুরু পরম্পরা
অদ্বৈত দর্শনের মতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি ব্যক্তি আসলে একই চেতনা। গুরুদেব শ্রী শ্রী রবি শংকর এই দর্শন ব্যাখ্যা করে বলেন, ” অদ্বৈত দর্শন ঠিক কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর মত যাতে বলা হয় যে জগতের সবকিছুই তরঙ্গ। রসায়ন বিজ্ঞান বলে যে অনেক মৌলপদার্থ এবং আইসোটোপ আছে। কিন্তু একজন কোয়ান্টাম পদার্থবিদের মতে পিরিয়ডিক টেবল এর অস্তিত্ব নেই, সবকিছুই হলো পরমাণু।”
পবিত্র অদ্বৈত জ্ঞানের ধারক ও বাহক গুরুবংশকে গুরু পরম্পরা বলা হয়। আদি শঙ্করাচার্য, ঋষি বেদব্যাস, মহর্ষি বশিষ্ট সকলেই এই গুরু পরম্পরার বিখ্যাত মহান গুরু।এনাদের অবদানেই যুগ যুগ ধরে অদ্বৈত জ্ঞান সজীব রয়েছে। উপনিষদ, ভগবৎ গীতার মত শাস্ত্র গ্রন্থ , অথবা আধ্যাত্মিক উপলব্ধি ও জ্ঞানের উৎস সবই হস্তান্তর হয়েছে তাঁদের মাধ্যমে।
অদ্বৈত জ্ঞানের গুরুদের বিস্ময়কর কাহিনী
প্রারম্ভে ছিলেন কেবলমাত্র শিব, যিনি অনন্ত চৈতন্য – তিনিই প্রথম গুরু। সজাগতার প্রতীক আদিশেষের সাহায্যে চেতনার সমুদ্রে ভাসছিলেন নারায়ণ। নারায়ণ যখন তাঁর চারপাশের চেতনার সঙ্গে নিজেকে এক করে উপলব্ধি করলেন, তখন বিশ্বের সৃজনশীল প্রবৃত্তির দেবতা ব্রহ্মার জন্ম হল। এরপর ব্রহ্মা নানান আকার গ্রহণ করলেন। তিন সূক্ষ্ম প্রাণশক্তি- শিব, নারায়ণ আর ব্রহ্মা সমগ্র সৃষ্টির চালনা করেন।
ব্রহ্মা চেতনা থেকে মানসপুত্র অর্থাৎ ব্যক্তি চেতনার জন্ম হল -ঋষি বশিষ্ট। বশিষ্ট ঋষি সমগ্র মনুষ্যজাতির মধ্যে সবচেয়ে আলোকপ্রাপ্ত যিনি শান্ত সমাহিত চিত্তে, কিভাবে জগত সংসারের সমস্ত কর্তব্য পালন করতে হয়, তার সম্পর্কে শ্রীরাম কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। শ্রীরাম আর ঋষি বশিষ্টের মধ্যে যে কথোপকথন হয়েছিল সেকথা যোগবশিষ্টতে লেখা আছে। এই শাস্ত্রে জগত সংসার যে কেবলমাত্র মায়া তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা রয়েছে।
বশিষ্ট মুনির পুত্র হলেন শক্তি এবং তাঁর পুত্রের নাম পরাশর। মহাকাল, জ্যোতিষ বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিদ্যা ও বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের উপরে ঋষি পরাশরের জ্ঞান অগাধ ও নিখুঁত ছিল। ঋষি পরাশর এক মৎস্যজীবিনী কে বিবাহ করেন এবং তাঁদের পুত্র কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস গুরুপরম্পরার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ ও মহাজ্ঞানী পণ্ডিত হয়েছিলেন।
ঋষি ব্যাসদেব সমগ্র বেদকে ক্রমানুসারে সাজানোর জন্যে গোটা ভারত উপমহাদেশ পরিক্রমা করে বিভিন্ন অঞ্চলের ঋষিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তিনি বেদের ১১৮০টি শাখার কথা জানতেন এবং বেদান্ত সূত্র (উপনিষদের সার) রচনা করেছিলেন। ভগবত গীতা যে মহাকাব্যের অন্তর্গত সেই মহাভারত, যোগসূত্র, ব্যাসভাষ্য, এবং শ্রীমৎ ভগবতম তাঁরই রচনা।
বেদব্যাস এর উত্তরাধিকারী ছিলেন তাঁর পুত্র শুকদেব যার আগমনের খুব আশ্চর্য একটা কাহিনী আছে। একবার ভগবান শিব দেবী পার্বতীকে একটা গল্প শোনাচ্ছিলেন এবং সেই গল্প শুনতে শুনতে দেবী পার্বতীর তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। একটি তোতা পাখিও সেই গল্পটি শুনছিল। গল্পটির জ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে তোতা পাখিটির সাধ হয় যে ভগবান শিব সেই গল্পটি বলা বন্ধ না করেন। তাই সে দেবী পার্বতীর সম্মতিসূচক শব্দগুলি নকল করে নিয়েছিল আর দেবী নিদ্রা যাবার পরেও সেই শব্দগুলি উচ্চারণ করে গিয়েছিল। গল্পটি শেষ হওয়ার পর পার্বতীকে নিদ্রিত দেখে মহাদেব বুঝতে পারলেন যে অন্য কেউ সম্মতি সূচক শব্দ করে চলেছে।
তিনি দেখলেন – পার্বতী নয়, তোতা পাখি। তিনি ক্রদ্ধ হয়ে তোতা পাখিটা কে তাড়া করলেন। পাখিটা ব্যাসদেব ও তার স্ত্রী যে কুটিরে থাকতেন, সেখানে আশ্রয় নিল। ঋষি ব্যাসদেব তোতা পাখিটির হয়ে ভগবান শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন ও পাখিটিকে আশ্রয় দিলেন। এর পরে তাঁর স্ত্রীর গর্ভে তোতা পাখিটির আত্মা প্রবেশ করেছিল। এই আত্মাকেই পরে নাম দেওয়া হয়েছিল শূকদেব। এই জগতের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে যাবে এই ভয়ে সে জন্ম নিতে ভয় পেয়েছিল আর সব আলোচনা সভায় তার পিতা যে জ্ঞান দিতেন, মাতৃগর্ভ থেকেই সেই জ্ঞান সে আত্মস্থ করে নিতে চেয়েছিল। ১৬ বছর পরে সে শুকদেব রূপে জন্মগ্রহণ করে অর্জুনের নাতি পরীক্ষিতকে ভক্তিমূলক শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতম শুনিয়েছিল। শ্রীমদ্ভাগতমে ভগবান বিষ্ণু ও তাঁর নানান অবতারের বিশেষ করে শ্রীকৃষ্ণের কথা আছে। এই গ্রন্থকে মনে করা হয় কলিযুগের চূড়ান্ত প্রতিকার ও উদ্ধারকর্তা।
অদ্বৈত গুরু পরম্পরায় এরকম আরো অনেক গুরু আছেন। তবে এর কয়েক যুগ পরে যখন সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বেশি প্রাধান্য পেতে শুরু করে তখন থেকে অদ্বৈত জ্ঞানের গভীরতার অসাধারণ বিস্ময়কর আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও মানুষের মনে তার জনপ্রিয়তা ও মূল্য হারিয়ে যেতে শুরু করে।
আদি শঙ্করাচার্য: মহান গুরু যিনি অদ্বৈত দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করেন
সপ্তম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য তাঁর গুরু গোবিন্দ ভগবত পাদের সঙ্গে বর্তমানকালের মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত নর্মদা নদীর তীরে সাক্ষাৎ করেন। গুরু গোবিন্দ শংকরাচার্যকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি কে?” তার উত্তরে আদি শঙ্করাচার্য নির্ব্যণশতকম রচনা করেন।
তার প্রথম স্থবকটি এইরকম:
मनोबुद्ध्यहङ्कार चित्तानि नाहं
न च श्रोत्रजिह्वे न च घ्राणनेत्रे ।
न च व्योम भूमिर्न तेजो न वायुः
चिदानन्दरूपः शिवोऽहम् शिवोऽहम् ॥१॥
মনোবুদ্ধ্যহঙ্কার চিত্তানি নাহং
ন চ শ্রোত্রজিহ্বে ন চ ঘ্রাণনেত্রে ।
ন চ ব্যোম ভূমির্ন তেজো ন বায়ুঃ
চিদানন্দরূপঃ শিবো’হম্ শিবো’হম্॥১॥
আমি মন, বুদ্ধি, অহং বা চিত্ত নই
আমি ,শ্রবণ, স্বাদ, ঘ্রাণ,দর্শনের ইন্দ্রিয় নই।
আমি আকাশ নই, পৃথিবী নই, আগুন, জল বা বায়ু নই
আমি শুভ চেতনা , সর্বোত্তম পরমানন্দের স্বরূপ, আমিই চিরন্তন শিব।
আমি শিব।
গুরু গোবিন্দ এই শিষ্যকে পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি তাকে সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষা দান করেন। এরপর গুরু গোবিন্দ শংকরাচার্যের ওপর কিছু দায়িত্ব কর্মের ভার দেন সনাতন ধর্মকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে। যে অদ্বৈত শাস্ত্র কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছিল তাকে শংকরাচার্য পুনরুজ্জীবিত করেন। বিস্মৃত উপনিষদের জ্ঞানকে তিনি জনসাধারণের কাছে খুব সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করেন। ভারত উপমহাদেশের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব,পশ্চিম এই চারটি প্রান্তে তিনি চারটি জ্যোতির্মঠ স্থাপন করেন।
এরপর শংকরাচার্যের শিষ্যরা ও পরবর্তী গুরু সমূদয় অদ্বৈত দর্শনের জ্ঞানকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করেন। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ আমরা যে সবাই এক – এই কথা উপলব্ধি করার সুযোগ আমাদের কাছে আছে।
স্বামী হরি হরার তথ্যের ভিত্তি করে