জীবনের তিনটি দিক
আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আমাদের তিনটি পর্যায়ের মধ্যদিয়ে যেতে হয়। জাগ্রত অবস্থা, স্বপ্নাবস্থা এবং নিদ্রা। আমরা এই তিনটি অবস্থাকে সঠিক বুঝতে পারিনা – সাধারণত আমরা এগুলিকে উপেক্ষা করি। এমনকি আমরা আমাদের স্বপ্নের প্রতিও কোন মনোযোগ দিয়ে থাকি না। গভীর নিদ্রার প্রতিও দৃষ্টিপাত করিনা এবং সেটি নিয়ে চিন্তা পর্যন্ত করিনা। আমরা যদি এটি করি তাহলে চেতনার চতুর্থ স্থর সম্পর্কে জানতে পারবো, যেটি এগুলির কোনটিই নয় কিন্তু এই সবগুলির পেক্ষাপটে রয়েছে, যেটি ধ্যানের মাধ্যমে উপলব্ধ হয়।
প্রতি রাতে যখন আমরা নিদ্রামগ্ন হই অথবা দিবাকালেও যখন আমরা স্বল্প সময়ের জন্য নিদ্রাচ্ছন্ন হই, তুমি কি জানো তখন কি ঘটে? যদি গভীর নিদ্রা হয় তখন আমরা সবকিছুর বাইরে চলে যাই। পরবর্তীটি হালকা নিদ্রা। এবং রেম (REM) ঘুম ( চোখ কাঁপতে থাকে এবং মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকে), এই স্তরে স্বপ্ন আসে।
জাগ্রত অবস্থা এবং নিদ্রা এই দু’ টি সূর্যোদয় ও অন্ধকারের মতো। স্বপ্ন এই দুই স্তরের মধ্যে গোধূলির আলোর ন্যায় এবং ধ্যান মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়ার মতো একটি অবস্থা যেখানে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত কোন কিছুই নেই।
-গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
তোমার তিনটি শরীর
প্রাচীন শাস্ত্র বলে আমাদের তিনটি দেহ : একটি কায়িক, সূক্ষ্ম শরীর এবং কারণ শরীর। আমাদের কারণ শরীরটি সমগ্র আবেগ ও চিন্তার দ্বারা গঠিত। আমরা যখন নিদ্রার রেম (দ্রুত চোখ কাঁপতে থাকা) পর্যায়ে থাকি তখন আমাদের সূক্ষ্ম শরীর সক্রিয় থাকে। স্বপ্ন স্তরে এটি কাজ করে। এই কারণে স্বপ্নে তুমি রং দেখতে পাও, তুমি সুগন্ধ অনুভব করো এবং স্পর্শকে অনুভব করতে পারো- এমনকি উষ্ণ আলিঙ্গনও অনুভব করতে পারো। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ ছাড়াই এই অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারো। স্বপ্নাবস্থায় আমাদের সূক্ষ্ম শরীর ক্রিয়াশীল থাকে।
বাস্তব জগতে অথবা যেটিকে আমরা বাস্তব জগত বলে বিবেচনা করি সেখানে জাগ্রত অবস্থায় আমরা যা করি স্বপ্নে সেগুলির অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করি।
কিন্তু গভীর নিদ্রায় আমরা শরীরের আরেকটি স্তরের অথবা তৃতীয় ভাগ, কারণ শরীরের অভিজ্ঞতা লাভ করি। গভীর নিদ্রায় আমাদের কার্যকারণ শরীর সক্রিয় হয়। সেটি সম্পূর্ণ প্রাণশক্তি যেখানে তুমি কোন সীমাবদ্ধতা অনুভব করতে পারবেনা, তোমার শরীরের অনুভূতিও থাকবেনা। কিন্তু গভীর নিদ্রা থেকে জেগে উঠে আমাদের কি অভিজ্ঞতা হয়? ভরপুর স্ফূর্তি।
তুমি যখন তোমার সূক্ষ্ম শরীরে থাকো এবং সমস্ত রাত্রি জুড়ে স্বপ্ন দেখো, যখন তোমার ঘুম ভাঙে তুমি ক্লান্তি অনুভব করো, কিন্তু তোমার গভীর নিদ্রার সময় তুমি তোমার কার্যকারণ শরীরের সঙ্গে থাকো( causal body) যেটি সর্বশক্তির উৎস, উৎসাহ, সজীবতা ও প্রাণবন্তের প্রতীক। সুতরাং গভীর নিদ্রা থেকে উত্থিত হয়ে আমরা ভরপুর প্রাণশক্তি ও সজীবতা অনুভব করি। আমরা প্রতি রাতেই নিদ্রামগ্ন হই, কিন্তু কখনোই নিদ্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়না। কখনোই আমরা গভীর নিদ্রার সহিত করমর্দন করিনা, ধ্যান তোমাকে এটি করতে সাহায্য করবে।
ধ্যান কি নিদ্রার সমার্থক?
ধ্যান গভীর নিদ্রার সদৃশ কিন্তু এইটি গভীর নিদ্রা নয়। তুমি যত অধিক সময় ঘুমোবে ততোধিক ক্লান্ত বোধ করবে এবং আলস্য বোধ হবে, কোন কিছু করবার ইচ্ছে ব্যাহত হবে। মাদক দ্রব্য যারা গ্রহণ করেন তাদেরও পরবর্তীতে এইরূপ পরিস্থিতি হয়। সেবন করার পর মানুষ সম্পূর্ণভাবে ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন, কোন উৎসাহই থাকে না।
ধ্যানের ক্ষেত্রে এটি হয়না। ধ্যান তোমার দেহের সেই স্থানে নিয়ে যায় যেখানে তোমার শক্তির উৎস, যেটি তোমার নিজস্ব দেহের অংশ, তোমার অন্তঃস্থ শরীর। ধ্যানের সমাপনে তুমি উচ্চ শক্তি লাভ করো এবং এটি স্বাস্থ্যকর। এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞান সম্মত ভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ধ্যান আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটায়।
বিশেষকরে কোভিড কালীন পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্বজুড়ে যারা স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত পেশার সঙ্গে যুক্ত তাঁরা ধ্যান করেছেন এবং এর উপকারিতা উপলব্ধি করেছেন। কোভিড-১৯ চলাকালীন বিশেষ করে প্রথম কিছু মাস যতক্ষণ না প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিসেবা জগতের সঙ্গে যারা যুক্ত তাঁরা অত্যন্ত চাপের মধ্যে ছিলেন। বুঝতে পারছিলেন না তাঁরা কি করবেন। কিভাবে রুগীদের চিকিৎসা করবেন? সেই সময় গুরুদেব বিশ্ববাসীর জন্য দিনে দু’ বার করে ধ্যান পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে দশ লক্ষের উপর ডাক্তার এবং নার্স অংশ গ্রহণ করে ছিলেন। তাঁদের মতামত অভূতপূর্ব ছিল, তাঁরা জানিয়েছিলেন এটি তাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং সেই কঠিন সময়ে তাঁদের শক্তি বজায় রাখতে প্রকৃত অর্থেই সাহায্য করেছিল।
অবচেতন অবস্থায় নীরবতায় চলে যাওয়ার অর্থই নিদ্রা। সচেতন ভাবে নীরবতাকে বেছে নেওয়াই ধ্যান। এইটি তোমাকে অধিক শক্তি প্রদান করে সূক্ষ্ম জগতের দ্বার খুলে দিতে সাহায্য করে।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর
মোক্ষ লাভের টিকিট
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মন এমন একটি পর্যায় পৌঁছায় যেখানে দ্রবীভূত হয় না। যখন মন এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রভাব থেকে সরে আসে এবং গভীরে পৌঁছায়, তখন কি ঘটে? তুমি সম্পূর্ণভাবে লয়বদ্ধ হয়ে যাও( যেটির অর্থ ছন্দবদ্ধ এবং ডুবে যাওয়া)। নিদ্রাকালীন অবস্থায় এটি ঘটিত হয়। নিদ্রামগ্ন অবস্থায় তুমি কোথায় থাকো? তুমি ডুবে যাও।
‘আমি, আমার, আমার’ এই ধারণাগুলি বন্ধনের কারণ। এইগুলি অন্তর্হিত হলেই মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। চব্বিশটি ঘন্টা তুমি আবদ্ধ থাকতে পার না। সেই কারণে তুমি ঘুমোতে যাও। ঘুমের মধ্যে যখন তুমি থাকো, ‘আমি, আমার, আমার ‘এই বোধ গুলি তোমার থাকেনা। যখন তুমি নিদ্রিত থাকো তখন কি হয় এবং তুমি কোথায় থাকো? তুমি তোমার নাম এবং পরিচয় হারিয়ে ফেলো। এমনকি তুমি এটিও বুঝতে পারনা তোমার শরীর বিছানায় শায়িত রয়েছে। তোমার প্রতিটি পরিচয় তুমি হারিয়ে ফেলো। তুমি এটি বলতে পারনা যে এটি শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের নিদ্রা এবং কেউ এটি নিতে পারবেনা। নিদ্রা নিদ্রাই হয়। সেখানে কোন শ্রী শ্রী এবং রবিশঙ্কর নেই– না কোন নাম আছে না আকার। একমাত্র নিদ্রা।
অপরপক্ষে ধ্যান হ’ল স্বজ্ঞানে সতর্ক থাকা এবং আমার মধ্যের আমির বিলুপ্তি। আমির অস্তিত্ব অন্তর্হিত হওয়ার অর্থই পরিত্রাণ; সেটিই মুক্তি।
নিদ্রার ক্ষেত্রে, কোন ব্যক্তি সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর যদি সেখানে মশার উপদ্রবও থাকে তথাপি গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়। নিদ্রাকে উপভোগ করতে হ’লে তোমাকে অধিক পরিশ্রম করতে হবে। এই পৃথিবীতে আমরা পর্যায়ক্রমে কেবল বিপরীত মূল্যবোধকেই উপভোগ করতে পারি, কিন্তু সমাধি থেকে প্রাপ্ত আনন্দ এর অপেক্ষায় অনেক বেশি। ধ্যান তোমাকে বিপরীত মূল্যবোধকে অতিক্রম করে নিয়ে যায়।
যোগ নিদ্রা (NSDR: Non – Sleep Deep Rest- নিদ্রা বিহীন গভীর বিশ্রাম)
প্রকৃতি তোমাকে বাধ্য করে অবচেতন ভাবে নিঃস্তব্ধতায় নিয়ে যেতে এবং সেটিই নিদ্রা। ঘুম তোমাকে স্ফূর্তি জোগায়। বর্তমানকালে অতিমাত্রায় স্বপ্ন দেখা এবং বহু কাজ করার প্রবণতা অনিদ্রা সৃষ্টির কারণ। তুমি শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়বে যখন তুমি দু’ টি বিষয় মনের মধ্যে রাখবে: “আমি কিছু চাই না, আমি কিছু করব না।”
সচেতন ভাবে নিদ্রিত হওয়া হ’ল যোগ নিদ্রা। তোমার যদি ঘুমের সমস্যা থাকে তুমি যোগ নিদ্রা চেষ্টা করে দেখতে পারো। নিদ্রা সংক্রান্ত একটি যোগার কোর্সও অন লাইনে করা যায়। উদ্বেগ ও অনিদ্রার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তুমি আর্ট অফ লিভিং এর কর্মশালা থেকে আরো অনেক কিছু শিখতে পারো।
ধ্যান চলাকালে নিদ্রা
একজন দর্শক সদস্য গুরুদেবকে প্রশ্ন করেছিলেন: ধ্যানস্থ অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়াটা কি ঠিক?
গুরুদেব উত্তর দিয়েছিলেন: তোমার যদি নাসিকা গর্জিত না হয় এবং অন্য সকলের অসুবিধার কারণ না হয় তাহলে এটি ঠিক! ধ্যানের অর্থ গভীর বিশ্রাম। সমাধি কি? এটি দশ লক্ষ বছরের বিশ্রামের সমতুল্য। তুমি যদি এক সেকেন্ড এর জন্যও ধ্যানস্থ হও এবং তার আগে অথবা পরে ঘুমিয়ে পড়ো, তাতে কিছু চিন্তার কারণ নেই।











