বিভিন্ন মানুষের কাছে আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন মানে হয় । কেউ তাকে যুক্ত করে ধর্মের সাথে, কেউ বা মহাশক্তিধর বা প্রকৃতির সাথে, আবার অনেকে মনে করে যে তা হল নিজের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ। যেভাবেই তুমি দেখোনা কেন, আধ্যাত্মিকতার উপকারিতা কিন্তু অনেক। তোমার মধ্যে ইতিবাচক রূপান্তর এনে তোমাকে জীবনে আরো সন্তুষ্ট করা , সবই সম্ভব হয় আধ্যাত্মিকতা বহুমাত্রিক বলে।
প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার বিরোধ কোনদিন হয়নি, তারা জীবনের বিভিন্ন দিক পূরণ করেছে; একটা বস্তু জগতের, অন্যটা সূক্ষ্ম জগতের। তারা পরস্পর বিরোধী নয়, বরং একে অন্যের পরিপূরক। সঠিক জীবনযাপনের জন্য এবং আমাদের প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য আধ্যাত্মিকতা আবশ্যক।
বস্তুকে বোঝা হল বিজ্ঞান । ‘আমি কে ?’ – তা উপলব্ধি করা হল আধ্যাত্মিকতা।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর
আধ্যাত্মিকতা গুরুত্বপূর্ণ কেন?
দেখো, আমাদের মূল পরিচয় সম্বন্ধে আমরা সচেতন থাকি বা না থাকি – সেটা কি আধ্যাত্মিকতার নিদর্শন নয়? আধ্যাত্মিকতা আমাদের অন্তরে উৎসের সঙ্গে যুক্ত করে, অতীতের দুঃখ ও ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ভুলে বর্তমান মুহূর্তে আনন্দময় ও সন্তোষপূর্ণ জীবন যাপন করতে সাহায্য করে।
তুমি কি জীবনের মানে খোঁজো?
তুমি কি কোনো ভাবে চিরন্তন সান্ত্বনার জন্য পিপাসু?
যখন তুমি প্রার্থনা এবং ধ্যান করো, তখন কি তুমি শান্তি পাও?
যখন তুমি সহানুভূতি দেখাও এবং অন্যকে সাহায্য করো, তখন কি তুমি গভীর তৃপ্তি অনুভব করো?
বিশ্বের কোনো মহাশক্তির কাছে সমর্পণ করে তুমি কি নিজেকে নিরাপদ বোধ করো?
যদি তুমি উপরোক্ত প্রশ্নের যে কোনো একটার উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলে থাকো তবে তুমি অবশ্যই আধ্যাত্মিক মনস্ক। তাই শান্তিতে জীবন কাটানোর জন্য আধ্যাত্মিকতা অতীব জরুরী।
যা আমাদের আত্মাকে পুষ্ট করে তাকে বলে আধ্যাত্মিকতা সঠিক পরিমাণে বিশ্রাম, কিছু জ্ঞান এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করাই হল আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ। সভ্য, সুন্দর ও আনন্দময় জীবনের জন্য এই সমস্ত কিছুরই প্রয়োজন।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর
আধ্যাত্মিক অভ্যাসের উন্নতি করার 7 টা উপায়
- ধ্যান
ধ্যান তোমাদের সচেতনভাবে চারপাশের সব কিছুকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। ইন্দ্রিয়কে শান্ত করে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তোমাদের প্রতিক্রিয়াকে উন্নত করে। মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য ধ্যান করলেই কিন্তু তোমরা চাপ, দুশ্চিন্তা এবং নেতিবাচক অনুভূতি যেমন রাগ, আঘাত, ক্ষোভ, অহং, হিংসা প্রভৃতিকে দূরে সরাতে পারো। সচেতনতার অভ্যাস করার জন্য ছোটখাটো বিবরণ যেমন বর্তমানে তুমি কোথায় আছো, তোমার চারপাশে কি আছে, তুমি কি করছো ইত্যাদি বিষয়ে মনোনিবেশ করলেই যথেষ্ট। ধ্যানের মাধ্যমে সচেতনতা অনেকটাই বৃদ্ধি পায়।
- যোগ এবং প্রাণায়াম
যোগ আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখে, জীবনীশক্তি বাড়ায় এবং নিজের ভেতরের আত্মার সঙ্গে একাত্ম বোধ করায়। যোগ একটা অসাধারণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে দেহে নমনীয়তা আসে এবং ভেতর থেকে দেহকে মজবুত করে। প্রাণায়াম আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস কে উন্নত করে সজাগতাকে বাড়ায়। আধ্যাত্মিক পথে উন্নতি করতে হলে যোগ ও প্রাণায়াম খুবই জরুরি।
- সমবেদনা ও ক্ষমাশীলতা
যখন জাগতিক সুখের চেয়ে আধ্যাত্মিক পথের দিকে তোমরা এগিয়ে যেতে চাও তখন সমবেদনা, ভালোবাসা ও ক্ষমাশীলতা বেড়ে ওঠে। তোমরা অপরকে যত্ন করো কারণ আপন-পর ভোগটা ঘুচে যায়। আত্মীয়তা সৃষ্টি হয় আর তোমরা অনুভব করো যে একই দৈবী চেতনার সূত্রে আমরা সবাই বাঁধা।
আধ্যাত্মিকতা হল জগতের সকল মানুষের সাথে আত্মীয়তা অনুভব করা।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর
- সন্তোষ এবং কৃতজ্ঞতা
কৃতজ্ঞ হওয়ার অভ্যাস করো এবং কি পাওনি তা নিয়ে অভিযোগ না করে যা পেয়েছো তা নিয়ে কৃতজ্ঞ হয়ে যাও। আধ্যাত্মিকতার পরিপ্রেক্ষিতে যে সন্তুষ্ট, সেই সব চেয়ে ধনী। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে আমোদপ্রমোদের নেশায় ডুবে গিয়ে সকলে ভুলে যায় যে একদিন সবকিছু হারিয়ে যাবে। জীবনে প্রাচুর্য উপলব্ধি করে পরিপূর্ণ জীবন যাপন করার জন্য যতটুকু পেয়েছো তার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া এবং জানা যে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যখন তুমি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠো, তখন তা কৃপা হয়ে ঝরে পড়ে তোমার জীবনে।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর
- ছন্দোবদ্ধ শ্বাস
ছন্দোবদ্ধ শ্বাসপদ্ধতি, যেমন সুদর্শন ক্রিয়া তোমাদের ফুসফুসকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে, চাপমুক্ত করে এবং জীবনের আলোকিত দিকে তাকানোর সুযোগ করে দেয়। তোমাদের চেতনাকে উন্নত করে বর্তমান মুহূর্তে অনেক আত্মবিশ্বাসী, শান্তিপূর্ণ এবং মনোযোগী করে তোলে। শুধু তাই নয়, রোগ নিরাময়ের সঙ্গে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়।
- নিঃস্বার্থ সেবা
আধ্যাত্মিকতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হলো স্বার্থহীন সেবা। আধ্যাত্মিকতা অভ্যাস করার একটা কার্যকরী উপায় হল অন্যকে সাহায্য করা। কোনো আদর্শের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হয়ে অপরকে সাহায্য করা। যাদের কিছুই নেই, তাদের সাহায্য করে সমাজকে কিছু দিতে পারলে মনে গভীর তৃপ্তি পাওয়া যায়। এতে আরও উপলব্ধি করা যায় যে তোমরা কত ভাগ্যবান, এবং এর ফলে তোমরা অনেক নম্র ও বিনয়ী হও।
উৎকৃষ্টতম সেবা হলো কারো মনের অবস্থার উন্নতি করা।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর
- অন্তরে দেখো
নিজের ভেতরে তাকিয়ে দেখে জানতে চেষ্টা করো কিভাবে তোমার জীবনীশক্তিকে আরো ভালো দিকে চালনা করা যায়। তা কি সাংবাদিকতা করে? না কি কোনো শখ, যেমন নাচ, গান বা ছবি আঁকার মাধ্যমে? লোকে পাহাড়ে বেড়াতে যায় প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে। তারা বলে এর প্রভাব কোনো ভেষজ ওষুধের চেয়েও উপকারী। তুমি যাকে বিশ্বাস করো, এমন কারো সাথে তোমার রুদ্ধ আবেগ নিয়ে কথা বলো। আধ্যাত্মিকতার অর্থ বুঝতে হলে নিজের মনের ভেতরে দেখো, কি সেই প্রক্রিয়া যা তোমাকে প্রশান্তি দেয়- তাকে অনুসরণ করো।
উপসংহার
আধ্যাত্মিকশক্তি তোমাকে সাহায্য করে নানাবিধ ছোট-বড় বিপত্তি কাটিয়ে জীবনযাপন করতে। আধ্যাত্মিকতা তোমাকে উপলব্ধি করায় যে মানবজীবনে সকলের সাথে তোমার আন্তঃসংযোগ রয়েছে এবং এই জীবনযুদ্ধে তুমি একা নও। তুমি জীবনকে নতুন করে মূল্যায়ন করো এবং সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে চলো। জীবনের সমস্যাকে জয় করার চেয়ে ভালো মুক্তির পথ আর কি হতে পারে?
আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হলো এমন আনন্দ আনা যা কেউ তোমার কাছে থেকে কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে না।
– গুরুদেব শ্রী শ্রী রবিশংকর